ফাঁস হলো রহস্য: সমুদ্রের অতল গভীরে কেন ডুবে গেল টাইটান সাবমেরিন

১৮ জুন ২০২৩ সন্ধের সময় ক্যানাডার সমুদ্র সৈকত থেকে টাইটান পাঁচজন ধনকুবের কে নিয়ে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য যাত্রা শুরু করে। তখন কেই বা জানতো যে এই যাত্রা টাইটান সাবমেরিন এর অন্তিম যাত্রা। আজ থেকে ১১২ বছর আগে টাইটানিক জাহাজ তার প্রথম যাত্রার সময় সমুদ্রের অতলে তলিয়ে গিয়েছিল। আর আজ সেই টাইটানিক কে দেখতে গিয়ে আর ফিরতে পারলো না টাইটান নামের ছোট্ট সাবমেরিন।

সমস্ত বিশ্বের মানুষের মনের মধ্যে হাজার প্রশ্নের ভিড়। কি এমন হলো যে টাইটান সাবমেরিন সমুদ্রের অতলে তলিয়ে গেল, কিভাবেই বা জানা গেল টাইটান আর কোনদিন ফিরবে না, যে সমস্ত ধনকুবেররা এই যাত্রার সঙ্গী ছিল তাদের দেহাবশেষ কি অবস্থায় রয়েছে।

২০২১ সাল থেকে টাইটান সাবমেরিন পর্যটকদের নিয়ে সমুদ্রের তলদেশে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়ে আসছে। কিন্তু আপনি কি জানেন এবার টাইটান সাবমেরিন এর কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত থাকা অবস্থাতেও পুনরায় সেই সাবমেরিনকে নিয়ে যাত্রা করাটা একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল।

টাইটানিক জাহাজ সম্পর্কিত তথ্য

১৯০৯ সাল থেকে ১৯১২ সালের সময়কালীন অবস্থায় দ্যা হোয়াইট স্টার লাইনস নামের একটি ব্রিটিশ শিপিং কোম্পানি হার্লেন্ড এন্ড উল্ফ নামের জাহাজ বানানো কোম্পানির সহায়তায় দুনিয়ার সব থেকে লাক্সারি জাহাজ বানায় যার নাম রাখা হয় টাইটানিক। যেখানে দাবি করা হয়েছিল যে টাইটানিক কখনই ডুববে না।

টাইটানিক জাহাজ
টাইটানিক জাহাজ

১৯১২ সালের এপ্রিল মাস প্রায় ২২২৪ জন প্যাসেঞ্জার নিয়ে টাইটানিক জাহাজ ইংল্যান্ড থেকে নিউ ইয়র্ক সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এবং ১৫ এপ্রিল ১৯১২ এই জাহাজ একটি বরফশিখরের সঙ্গে ধাক্কা লাগার পর প্রায় দেড় হাজার যাত্রী নিয়ে সমুদ্রের তলদেশে ডুবে যায়। বাকি যাত্রীরা কোনো মতে প্রাণ বাঁচায়। আশ্চর্জজনকভাবে টাইটানিক জাহাজের সেটাই ছিল প্রথম যাত্রা। আর সেই প্রথম যাত্রাতেই তৎকালীন সময়ের প্রায় সাড়ে সাত মিলিয়ন ডলার খরচ করে তৈরি করা এই জাহাজ ডুবে যায়।

সমস্ত মানুষের কৌতুহল এক নিমেষে ভয়ানক আশঙ্কায় পরিণত হয়। এবং তৎকালীন আমেরিকা সরকার ও অন্যান্য দেশের সরকার ও সমুদ্র বিজ্ঞানীরা অনেক খোঁজ করেও এই জাহাজের কোন হদিস করতে পারে না। শেষমেষ ১৯৮৫ সালে প্রায় ৭৩ বছর পর আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়।

এরপর থেকেই বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও গবেষণা সংস্থা ও সরকারের যৌথ পরিকল্পনাতে সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখা ও নমুনা সংগ্রহের কাজ চলে আসছে।

টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখা

তৎকালীন সময় থেকেই টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষের উপর কপিরাইট কার হবে সে নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এবং শেষমেষ ওশিয়ান গেট নামের এক কোম্পানি টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষের মালিক হন।

টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ
টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ

পরবর্তী সময়ে ওসিয়ান গেট কোম্পানি টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ জনসাধারণের জন্য খুলে দেন। এবং নিজেদের তৈরি সাবমেরেনে করে পর্যটকদের আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে নিয়ে গিয়ে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ পর্যবেক্ষণ করাতেন। কোম্পানি এই কাজ ২০২১ সাল থেকে করে আসছে।

টাইটন সাবমেরিন সম্বন্ধীয় তথ্য

টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ পর্যটকদের উদ্দেশ্যে খুলে দেওয়ার লক্ষ্যে ওসিয়ান গেট কোম্পানি টাইটান নামের একটি ছোট্ট সাবমেরিন তৈরি করেন। যেই সাবমেরিনে চাপিয়ে পর্যটকদের টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখানো হতো। এই সাবমেরিনে একবারে ৫ থেকে ৬ জন বসে সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে ধ্বংসাবশেষ দেখে পুনরায় ফিরে আসতেন।

২০২১ সাল থেকে এই কাজ টাইটার নামে সাবমেরিন বেশ কয়েকবার করে ফেলেছে। সেই একই লক্ষ্যে গত ১৮ জুন কানাডার সমুদ্র সৈকত থেকে পাঁচ জন যাত্রী নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে টাইটান যাত্রা করেছিল।

টাইটান সাবমেরিন
টাইটান সাবমেরিন

এখানে জানিয়ে রাখি এই সাবমেরিনে চেপে সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য এক একজন যাত্রীকে কমপক্ষে ২ কোটি টাকার টিকিট কিনতে হয়। তাহলে বুঝতেই পারছেন এই যাত্রাতে কোন সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে না।

এবারেও যেনারা যাত্রা করেছিলেন ওনারাও কোন সাধারণ মানুষ ছিলেন না, সর্বপ্রথম ওসিয়ান গেট কোম্পানির মালিক নিজে ছিলেন, এছাড়াও নাসার গবেষক, ও একজন বড় ব্যবসায়ী ও তার ১৯ বছরের পুত্র।

টাইটান সাবমেরিন ডুবে যাওয়ার কারণ কি

টাইটান সাবমেরিন যে আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে ডুবে গিয়েছে ও টাইটানিক জাহাজের পাশেই তারও ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে এ কথা সত্য। কিন্তু কি এমন ঘটনা ঘটেছিল? বা কি এমন কারণ হতে পারে? তার নিখুঁত তথ্য এখনি বলা সম্ভব নয়।

কিন্তু বিশেষজ্ঞদের আনুমানিক ধারণা হিসেবে টাইটান সাবমেরিন সমুদ্রের তলদেশের অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে না পেরে বেলুনের মতো ফেটে গিয়েছে। যার ফলে তার ভেতরে থাকা সমস্ত যাত্রীদের শরীরও এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছে।

টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আটলান্টিক মহাসাগরের সমুদ্র তল থেকে প্রায় চার কিলোমিটার নিচে রয়েছে। যেখান পর্যন্ত পৌঁছাতে এবং ফিরে আসতে টাইটান সাবমেরিন এর ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু এবার টাইটান সাবমেরিন জলে ডুব দেওয়ার ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট পর তার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় যা আর কখনোই পুনরায় যোগাযোগ করা যায়নি। এবং টাইটান সাবমেরিনে থাকা অক্সিজেন অনুযায়ী যখন ৯০ থেকে ৯২ ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর ধরে নেওয়া যায় যে টাইটান সাবমেরিন আর কখনোই ফিরবে না।

যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা পর থেকেই আমেরিকা কোস্ট গার্ড, কানাডা কোস্ট গার্ড ও অন্যান্য সংস্থা মিলে টাইটান সাবমেরিনকে খোঁজার কাজ শুরু করে দেয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় খোঁজার পরেও টাইটান সাবমেরিনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে রোবট মেশিন জলের তলায় পাঠিয়ে দেখা যায় যে টাইটান সাবমেরিন এর কিছু অংশ টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষের পাশে পড়ে রয়েছে।

Leave a Comment